দেশবিদেশ রিপোর্ট | বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ ২০২১
কক্সবাজারের উখিয়ায় মঙ্গলবার রাতে আরো একটি রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, বালুখালী শিবিরের মত করেই সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপের সদস্যরা আগুন দিয়ে দ্রুত পালিয়ে গেছে। উখিয়ায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে ‘বড় শরনার্থী শিবির’ হিসাবে পরিচিত কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরের এফ ব্লকে ঘটেছে এ ঘটনা। আগুনের খবর পাওয়া মাত্রই শিবিরটির দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারা দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন।
কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার মধ্যরাত ১২ টার দিকে এফ ব্লকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পার্শ্ববর্তী রোহিঙ্গারা আগুন দিয়ে তিনজনকে দৌঁড়ে পালাতেও দেখেছে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ শিবিরের দায়িত্বে থাকা ক্যাম্প ইনচার্জ অফিসের লোকজন ও এপিবিএন এর সদস্যরা এসে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে গতকাল সন্ধ্যায় জানিয়েছেন-‘ এ ধরণের একটি ঘটনা ঘটেছিল। তবে তৎক্ষণাৎ আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়েছে।’ সোমবারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর থেকেই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে এখন ‘আগুন আতংক’ বিরাজ করছে। গতকাল বুধবার বিকাল তিনটার দিকে কুতুপালং শিবিরের লম্বাশিয়া এলাকার চার মুয়া কুনাকুনি মসজিদ সংলগ্ন স্থানেও আগুন লাগিয়ে দেয়ার একটি ঘটনা ঘটে। স্থানীয় একাধিক রোহিঙ্গা এ তথ্য জানালেও তবে কর্তৃপক্ষীয় কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় এরকম নানা গুজবও ছড়ানো হচ্ছে।
স্বদেশে ফিরে যাওয়া বিলম্বিত এবং ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করার জন্যই সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে একের এক অস্তিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টিকারি সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাগিদ উঠেছে সাধারণ রোহিঙ্গা ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে।
এদিকে গত সোমবারের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে গৃহহারা হয়ে পড়া রোহিঙ্গারা নতুন করে জীবন-জীবিকার কাজ শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিভিন্ন দেশী-বিদেশী এনজিও সহ সরকারি সহযোগিতায় পুড়া ভিটায় গড়ে উঠছে তাবুর পর তাবু। এসব রোহিঙ্গাদের জন্য গাড়িতে গাড়িতে খাবার সরবরাহ করছে এনজিওগুলো। এনজিওদের নেওয়া নির্মাণ সামগ্রীর বিশাল স্তুপ পড়েছে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ রোহিঙ্গা শিবিরের বিরান মাটিতে। কেউ খাবার সরবরাহ দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে পানি সরবরাহ আবার কেউবা তাবু টাংগানোর কাজে ব্যস্ত। সব মিলে লন্ডভন্ড শিবিরে নতুন যাত্রার এক শুভ সূচনার দৃশ্য চোখে পড়ছে সবার।
সেই রোহিঙ্গা শিবিরটির পার্শ্বেই রয়েছে আগুনে গৃহহারা স্থানীয় গ্রামবাসীদের পুড়া ভিটাও। কিন্তু এসব গ্রামবাসীদের ভিটাগুলোতে এখনো বিরাজ করছে স্যুনশান নিরবতা। এসব ভিটায় এখনো শুরু হয়নি নতুন জীবনের যাত্রা। এমন বৈপরিত্য দৃশ্য নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। উপরন্তু আগুনে গৃহহারা রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার দিতে এনজিও গুলো শিবিরে যেখানে গিজ গিজ করছে, সেখানে স্থানীয় গৃহহারা ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে কোন এনজিওর উপস্থিতি নেই।
বালুখালী রোহিঙ্গা শিবির সংলগ্ন পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুল আমিন বুধবার সন্ধ্যায় দুঃখের সাথে বলেন-‘ আমাদের চোখের সামনেই সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা শিবিরটিতে একের পর একটি স্থানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সেই আগুনে ওরাও পুড়ল আমরাও পুড়লাম। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার, পুড়ার পর ওরা খাবার-দাবার পেলেও আমাদের কোন খবর নেই।’ তিনি বলেন, তার পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে খোলা আকাশের নিচে খেয়ে না খেয়েই রয়েছেন।
স্থানীয় গ্রামবাসী জাহেদ আলম জানান, তার পরিবারের ৬ সদস্য নিয়ে শিবিরের কাঁটাতারের ভিতর রোহিঙ্গাদের সাথে বসবাস করাটাই যেন তাদের জন্য অভিশাপ ডেকে নিয়ে এসেছে। তাদের চোখের সামনেই রোহিঙ্গারা জামাই আদর ভোগ করলেও গ্রামবাসীরা বঞ্চিত রয়েছেন। উপরন্তু কাঁটাতারের ভিতর থেকে গ্রামবাসীদের সরিয়ে দিতেও রোহিঙ্গা শিবিরের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা চাপ দিচ্ছেন বলেও তার অভিযোগ। এমনকি বালুখালী ৯ নম্বর শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) কাঁটাতারের ভিতর বসবাসকারি আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে তাদের ওই এলাকা ছাড়ার জন্য চাপাচাপি করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগ হচ্ছে, ৯ নম্বর শিবিরের সিআইসি কাঁটাতারের ভিতর শত শত বছর ধরে বসবাসকারি গ্রামবাসীকে যে কোন ভাবে সরিয়ে দিতে মরিয়া হযে পড়েছেন। চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিনের দুঃখ হচ্ছে-এদেশের জনগনের ট্যাক্সের বেতন খাওয়া একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তিনি কিভাবে এবং কোন সাহসে স্থানীয় গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধাচারণ করেন ?
এ বিষয়ে শরনার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজোয়ান হায়াত জানান-‘ অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসীদের জন্য বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বৃহষ্পতিবার থেকে তাদেরও দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, কাঁটা তারের ভিতর থাকা গ্রাবাসীদের কোনভাবেই সরানো হবে না। আরআরআরসি এমন নিশ্চয়তাও দেন যে, কিছুতেই গ্রামবাসীদের মর্যাদা এবং স্বার্থ হানিকর কোন কাজ করা হবে না। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, গত সোমবারের অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসীদের তালিকা করার জন্য ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠণ করে দেওয়া হয়। উক্ত কমিটি ক্ষতিগ্রস্থ ১৪৬ জন গ্রামবাসীর তালিকা করেছে। এসব ক্ষতিগ্রস্থদের সরকারি ত্রাণ সামগ্রী যথা চাল-ডাল ও তেল দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, গত সোমবার বিকালে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এঘটনায় বসত ঘর সহ সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে প্রায় রোহিঙ্গা ও গ্রামবাসী মিলে প্রায় ৫০ হাজার। ত্রাণ মন্ত্রণালয় সচিব মোঃ মোহসীন জানিয়েছেন, অগ্নিকা-ের ঘটনা তদন্তে আট সদস্যের কমিটি কাজ শুরু করে দিয়েছে। তিন দিনের মধ্যেই তারা রিপোর্ট জমা দেবে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় জরুরি সহায়তা হিসেবে ১০ লাখ টাকা ও ৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
Posted ১:১৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ ২০২১
ajkerdeshbidesh.com | ajker deshbidesh