শফিক আজাদ, উখিয়া | বৃহস্পতিবার, ২১ জুন ২০১৮
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযঞ্জ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সরকারি-বেসরকারি ভাবে সব ধরনের সহযোগিতা পেলেও তারা সামাজিক ভাবে সুখে নেই। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে হিংস্বার্থক অস্থিরতা। আধিপাত্য বিস্তার, পূর্বশত্রুুতার জের, অভ্যান্তরিণ কোন্দল সহ প্রত্যাবাসনে পক্ষে-বিপক্ষে অবলম্বনকে কেন্দ্র করে চলছে মারামারি, হানাহানি, ছুরিকাঘাতের মতো লোমহর্ষক ঘটনা। সম্প্রতিক সময়ে উখিয়ার বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্পে প্রায় ডজন খানেক রোহিঙ্গা নেতা খুন হয়েছে রোহিঙ্গাদের হাতে। সর্বশেষ গত সোমবার রাত ৮টার দিকে শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা (হেড মাঝি) আরিফ উল্লাহকে গলাকেটে হত্যা করার ঘটনা নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে চলছে অরাজক পরিস্থিতি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে রাত যাপন করছে সাধারণ রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রোহিঙ্গা অধ্যূষিত এলাকা পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, রোহিঙ্গারা হিংস্বার্থক মনোভাব নিয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে খুন,খারাবি করতে কোনরূপ বিলম্ব করেনা। রোহিঙ্গাদের এস সমস্ত অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের মাঝে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সরকারি ভাবে প্রশাসনের লোকজন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এনজিও নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্প গুলোতে রোহিঙ্গারা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কর্মকান্ড পরিচালনা করার সুযোগ পাওয়ার কারনে অপ্রীতিকর ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। ময়নারঘোনা ক্যাম্পের আবু তাহের মাঝি জানায়, রোহিঙ্গারা পরাশ্রীকাতর তারা অন্যের নেতৃত্ব সহ্য করতে পারেনা। তাছাড়া অভ্যান্তরিণ কোন্দল নিয়ে প্রতিনিয়ত ক্যাম্পে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও এনজিওরা থামাতে পারছেনা। যে কোন সময়ে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে। সে জানান, গত ১৮ জুন (সোমবার) রাত ৮টার দিকে রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা (হেড মাঝি) আরিফ উল্লাহ নিজ বাসায় ফেরার পথে বালুখালী ১১ ব্লকের পাশর্^স্থ রাস্তার উপরে ৭/৮জন দুর্বৃত্ত গলাকেটে হত্যা করে। এসময় সে প্রাণে বাচার জন্য শত চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের জানান, আরিফ উল্লাহ নৃশংস হত্যাকান্ডের ব্যাপারে পুলিশ তদন্ত করছে। তবে পারিবারিক ভাবে এখনো কেউ অভিযোগ না করায় হত্যাকান্ডে জড়িতদের আটক করা সম্ভব হচ্ছেনা। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারী কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৪ ব্লকে বাসিন্দা মমতাজ আহমদ (৩৫) দোকান থেকে বাড়ী ফেরার পতিমধ্যে ৫/৬জন মুখোশধারী দুর্বৃত্ত তাকে অপহরণ করে পাশর্^বর্তী মধুরছড়া জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে হাত-পা বেধে গলাকেটে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। পরদিন উখিয়া থানা পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ১৯ ফেব্রুয়ারী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে স্বামীর হতে খুন হয় স্ত্রী রেনুয়ারা বেগম(৩২) পুলিশ ঘাতক স্বামী মোঃ হোছনকে গ্রেফতার করেছে। ২১ জানুয়ারী রাখাইনে সাতগরিয়া পাড়ার হুকাট্টা (চেয়ারম্যান) থাইংখালী তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের নিজ বাড়ী বসে পরিবার পরিজনদের সাথে আলাপচারিতাকালে রাত সাড়ে ১০টার দিকে কে বা কারা গুলি করলে মোহাম্মদ ইউছূপ (৪৬) ঘটনাস্থলে মারাযায়। তার পরিবারের দাবী সে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করার কারনে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এব্যাপারে উখিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে নিহতের পরিবার জানিয়েছেন। ২৩ জানুয়ারী ভোর রাতে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মসজিদের ইমাম ইউছূপ জালাল (৬০) আযান দেওয়ার জন্য মসজিদে আসার সময় আগে থেকে উৎপেতে থাকা ৫/৬জন দৃর্বৃত্ত পেছন থেকে এলোপাতাড়ী ছুরিকাঘাত করলে সে ঘটনাস্থলে মারাযায়। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে। ২মার্চ রাত ৮টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পের ই ব্লকের বাসিন্দা আবু তাহের (৩০) কুতুপালং বাজার থেকে নিজ বাড়ীতে ফেরার সময় উৎপেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাকে উপযুপরী ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এসময় সে আত্মচিৎকার করলেও আশে-পাশের কোন রোহিঙ্গা নাগরিক এগিয়ে আসেনি বলে প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন খুন, খারাবির ঘটনায় গেলে সাক্ষী হতে হয়, যেকারনে রোহিঙ্গারা তাকে বাচাতে যায়নি। ১৬ মার্চ থাইংখালী তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের অদুরে জঙ্গল থেকে পুলিশ অজ্ঞাতনামা এক রোহিঙ্গা মৌলভীর লাশ উদ্ধার করেছে। ১৭মার্চ কুতুপালং ক্যাম্পে প্রতিপক্ষরা হাতুড়ি দিয়ে নির্মম ভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছে নুর হাকিম (৩৫) নামের এক সাধারণ রোহিঙ্গাকে। তার দোষ সে নাকি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন খবরা খবর আইনশৃংখলাবাহিনীকে সরবরাহ করতো। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। গত বছরের জুন মাসে কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম নামের এক রোহিঙ্গা সোর্সকে প্রতিপক্ষরা প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, নুরুল ইসলাম রোহিঙ্গাদের নানা অপকর্মের খবরা খবর স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সরবরাহ করতেন। যে কারনে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একই ভাবে গত বছরের জুন মাসে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আল ইয়াকিনের সদস্যরা কুতুপালং ক্যাম্পে হানা দিয়ে ক্যাম্পের মাঝি মোঃ আইয়ুব (৩৩) ও তার পাশের বাড়ির মোঃ ছলিম(২৫) কে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ২দিন পর পুলিশ বালুখালী খাল থেকে অপহৃত মাঝি সহ ২জনের লাশ উদ্ধার করে। কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ডাঃ জাফর আলম প্রকাশ ডিপো জাফর বলেন, এখানে যে সমস্ত রোহিঙ্গা যুবকেরা রয়েছে তাদের অধিকাংশই আল ইয়াকিন, আরসা সহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, ক্যাম্পের ত্রাণ ভাগাভাগি, অভ্যান্তরিণ কোন্দল বা পূর্বশত্রুুতার জের ধরে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। যে কারনে ক্যাম্পে খুন খারাবি বাড়ছে। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের বলেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ৭টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হলেও লোকবল সংকটের কারন বা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে দুরত্বের কারনে অনেক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। তথাপিয় আগের তুলনায় অনেকাংশে খুন,খারাবি কমেছে।
Posted ২:৩২ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২১ জুন ২০১৮
ajkerdeshbidesh.com | ajker deshbidesh