মুকুল কান্তি দাশ, লোহাগাড়া থেকে ফিরে..... | শনিবার, ০৬ অক্টোবর ২০১৮
নুন আনতে পানতা ফুরনো বয়োবৃদ্ধ আবুল শরিফ প্রকাশ লেদু মিয়ার এখন হাজার তরুণের আউডল। পড়ালেখা না করলেও মেধা ও ইচ্ছা শক্তির জুরে পরিবারকে স্বাবলম্বী করা এবং সমাজসেবায় জড়িয়ে নিজেকে আলোকময় করে তুলার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার লেদু মিয়া। ১৯২৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। সে হিসেবে লেদু মিয়ার বয়স ৯৫ বছর। নিজে পড়তে না পারলেও ছয় সন্তানকে শিক্ষিত করেছেন। গড়ে তুলেছেন সৎভাবে উর্পাজনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার চেতনাময় করে। তিনি দেখেছেন বৃটিশ শাসন। দেখেছেন পাকিস্তানীদের শোষন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে পালিয়ে যাওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘর-বাড়ি-মন্দির পাহারও দিয়েছেন তিনি।
নিকটবর্তী পাহাড় থেকে লাকড়ী ও ধান এনে বিক্রয় করে কোনভাবে সংসার চালানো লেদু মিয়া এখন লোহাগাড়ার আলোকিত মুখ। হতাশাগ্রস্ত তরুণ যুব-সমাজের উদ্দীপনার আইডল। লেদু মিয়ার কর্মময় জীবনের জীবন্ত গল্প শুনেই উঠতি তরুণরা সৎ পথে পদার্পন করারও নজির রয়েছে।
৪ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক লেদু মিয়া নিজের সন্তানদের শিক্ষিত করার পাশাপাশি গ্রামের পিছিয়ে পড়া হতদরিদ্র সন্তানদের পড়ালেখার সুবিধার কথা ভেবে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্টার ক্ষেত্রে রেখেছেন বিশেষ অবদান। শতবছর ছুই ছুই লেদু মিয়ার সাথেই বয়োবৃদ্ধ স্ত্রীরও রয়েছে মধুর সম্পর্ক। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তারা তাদের সংসার নিয়ে সুখি।
এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম সেই আবুল শরিফ প্রকাশ লেদু মিয়ার বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের নেজাম উদ্দিন মুন্সি পাড়ায়। তার বাবা মৃত মুন্সি আবদুল রশিদ বৃটিশ আমলের মেম্বার। লেদু মিয়ার দাদা ছিলেন বৃটিশ আমলের প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ চেয়ারম্যান। ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নিলেও দেড় বছর বয়সে পরিবারের ছায়া বাবাকে হারিয়ে ইচ্ছে থাকা সত্বেও পড়া-লেখা করতে পারেননি। নিমজ্জিত হন দারিদ্রতার কাতারে।
লেদু মিয়া ১৯৫৯ সালে ৩২৫ টাকা দিয়ে একটি সাইকেল ক্রয় করেন। সেই সাইকেলটি ৫৯ বছর ধরে তার সঙ্গি। সেই সাইকেল অতিরিক্ত খরচ বাচিয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ধান মাড়াইয়ের জীবনের গল্প শুরু তার। এখন সেই সাইকেলটি জীবনের স্মৃতি হিসেবে স্বযতেœ রেখেছেন লেদু মিয়া। সাইকেলটি জীবনের মোড় ঘুরাতে অবদান রাখায় সন্তানদের আগেই বলে রেখেছেন মৃত্যুর পরও সাইকেলটি স্বযতেœ রাখতে।
সাইকেলটির অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। সাইকেলটির বিভিন্ন পার্টসে জং ধরেছে। কিছু কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে। তবুও সাইকেলটি যতœ করে আগলে রেখেছেন। গত বৃহস্পতিবার কলাউজান ইউনিয়নের নিজতালুক গ্রামে লেদু মিয়ার সাথে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের।
এসময় লেদু মিয়া বলেন, আমার বয়স ৯৫ বছর চলছে। আমার সাইকেলটির বয়স ৫৯ বছর। যৌবন কাল থেকেই এই সাইকেলটির সাথে আমার সম্পর্ক। এই সাইকেলের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এটা অনেকটা আমার ছেলের মতো। মায়া লেগে গেছে। অনেকে কিনতে চেয়েছিলো। বিক্রি করিনি। ছেলেদের বলেছি আমার মৃত্যুর পরও যাতে সাইকেলটি যতœ করে রাখে।
তিনি আরো বলেন, এই সাইকেল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছি। পাহারা দিয়েছি হিন্দুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির। যার কারণে হিন্দু লোকজনের সাথে আমার পরিবারের গভীর সম্পর্ক। আমি মরে গেলে হয়তো এই সম্পর্ক আর থাকবেনা। এখনো কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেলে এই সাইকেল চড়ে যাই।
লেদু মিয়া তার ৯৫ বছর জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, পড়া-লেখা শিখতে পারিনি। লিখতে পড়তে জানতাম না। মনে খুব আক্ষেপ ছিলো। কিন্তু কি আর করার কপালে যে লেখাপড়া ছিলোনা।
তিনি বলেন, যখন আমার বয়স ১৮-২০ বছর, তখন আমি পাহাড়ে যাওয়া শুরু করলাম। পাহাড় থেকে কুড়িয়ে লাকড়ী আর ধান নিয়ে আসতাম। ওই ধানগুলো ভেঙ্গে চাউল করার জন্য যখন রাইস মিলে যেতাম তখন মিলওয়ালা ধান অথবা টাকা চাইতো। তখন টাকা দিয়ে ধান ভেঙ্গে চাউল করে আনতাম।
একদিন চিন্তা করলাম রাইস মিলের ব্যবসাতো ভালই। লেখাপড়া লাগেনা। নগদ টাকার কাজকারবার। তখন পদুয়া বাজার থেকে ১৫’শ টাকা দিয়ে একটি ধান চুড়ানোর মেশিন ক্রয় করি। পরে সেটি বাড়ির পাশে বসিয়ে এলাকার লোকজনদের জানিয়ে দিই। ধানের মেশিনটি বসানোর একমাসের মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার টাকা আয় করি। পরে ওই টাকা দিয়ে আরো তিনটি মেশিন ক্রয় করি। এভাবেই চারটি মেশিনের মালিক হই। জমতে থাকে টাকা।
তিনি আরো জানান, নিজে যখন লেখা-পড়া করতে পারিনি অন্তত ছেলেমেয়েরা যাতে লেখাপড়া করতে পারে সেজন্য একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করার চেষ্টা করি। তবে মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করার মতো সামর্থ্য আমার ছিলোনা। তাই আত্মীয়-স্বজনদের নানাভাবে প্ররোচনা জুগিয়েছি মাদ্রাসা প্রতিষ্টার জন্য। পরে আমার আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশিরা মিলে শাহ আবদুর রশিদ হুজুরের নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করে। আমি তৎকালিন আড়াই লক্ষ টাকা দিই মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য। এখন শাহ রশিদিয়া ফাজিল মাদ্রাসাটি সরকারীকরণ করা হয়েছে। আমার জীবনে আর কোন চাওয়া নেই। বাকী জীবনটুকু আল্লাহর ইবাদত করে কাটিয়ে দিতে চাই।###
Posted ১:৩৯ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৬ অক্টোবর ২০১৮
ajkerdeshbidesh.com | ajker deshbidesh