তোফায়েল আহমদ | বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারি ২০১৯
মাত্র একদিন আগে অনুজপ্রতিম সংবাদকর্মী নুরুল করিম রাসেলকে বলেছিলাম-হারানোর পরই বুঝবে, বাবা-মা’র মর্ম। তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম স্যারকে নিয়ে এক সাথে খাবার-দাবারের চেষ্টা করবে। তাঁর এখন বয়স হয়েছে। একাকী জীবন তাঁর ভাল লাগবে না। এমনিতেই গত কিছুদিন ধরে তাঁর শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। তার একদিন পরেই এডভোকেট ফরিদ গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে মোবাইলে খবরটা দিয়ে জানালেন-তার শ্বশুর মোহাম্মদ আবদুস শুকুর মাষ্টার আর নেই। কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বাতিঘর হিসাবে পরিচিত মাষ্টার মোহাম্মদ আবদুস শুকুর গতকাল বুধবার সকালে পৌণে আটটায় বার্ধক্য জনিত রোগে ইন্তেকাল করেন ( ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)।
কর্মজীবন শেষে সব মানুষই হয়তোবা চেয়ে থাকেন কর্মের একটুখানি স্বীকৃতি। মাষ্টার আবদুস শুকুর এরকমই সামান্য স্বীকৃতি হাতে পেয়ে আবেগে কেঁদেছিলেন। তাঁর সেই কান্নার পর থেকেই মানুষটার প্রতি আমার স্বভাবজাত দুর্বলতা শুরু। প্রায়শ খোঁজ-খবর নিতাম স্যারের। দীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষকতার দীর্ঘ সময় তিনি পার করেছেন উখিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। শিক্ষকতার শুরু হয়েছিল টেকনাফ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। এমন সময়েই সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তিনি একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ব্যক্তিগত জীবনে দীর্ঘসময় শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। কক্সবাজার জেলার একজন আদর্শ শিক্ষক এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগটক হিসাবে দৈনিক কালের কন্ঠের তরফে সন্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিই আমি। এ কারনেই তিনিও আমার প্রতি এমনভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে-প্রায়শ আমার খবরা-খবর নিতেন।
অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের লোক ছিলেন মাষ্টার মোহাম্মদ আবদুস শুকুর। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক যাকে বলে সেরকম লোক ছিলেন তিনি। স্বল্পভাষী এমন লোকটি খোঁজ-খবর নিতেন তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্টানের শিক্ষার্থীদের। পরের সন্তানদের মানুষ করার জন্য তিনি ছিলেন মরিয়া। মাষ্টার আবদুস শুকুর সারা জীবন অন্যের সন্তানদের মানুষ করে সময় কাটিয়েছেন বটে তাই বলে নিজের সন্তানরা কেউ অমানুষ থাকেননি। তাঁর সাত সন্তানের (৩ ছেলে ও ৪ মেয়ে) সবাই গ্রাজুয়েট এবং মাষ্টার্স ডিগ্রীধারী। বলা যায় তিনি এটা প্রকৃতির বিনিময় পেয়েছেন।
আজ তাঁর কথা আমার সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে এক বিশেষ কারনে। সেটি হচ্ছে ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি কালের কন্ঠের প্রতিষ্টাবার্ষিকীতে আমি এই শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগটক সদ্য প্রয়াত মাষ্টার মোহাম্মদ আবদুস শুকুরকে সংবর্ধিত করেছিলাম। আজ বৃহষ্পতিবার ১০ জানুয়ারি কালের কন্ঠের আরো একটি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন। আজকের দিনে কালের কন্ঠের সন্মাননা প্রাপ্ত সেই শিক্ষাবিদ আর বেঁচে নেই।
একটানা ৪৩ বছর শিক্ষকতা করার পর অবসরে যাওয়া এই শিক্ষকের হাতে সেদিন কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের হল রুমের অনুষ্টানে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ কালের কন্ঠের পক্ষ থেকে সম্মাননা হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান এবং উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়েছিল। সন্মাননা গ্রহনের পর আবেগাপ্লুত এই কৃতি শিক্ষক সেদিন দু’চোখের পানি ফেলে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন-‘জীবন সায়াহ্নে সন্মাননা পেয়ে কালের কন্ঠ এবং সাংবাদিক তোফায়েল আহমদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’ প্রয়াত স্যারের এমন বাক্যটি আমার কানে বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
Posted ১:৩৯ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারি ২০১৯
ajkerdeshbidesh.com | ajker deshbidesh