নিজস্ব প্রতিবেদক,মহেশখালী | শনিবার, ১৩ জুলাই ২০১৯
মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের চালিয়াতলী এলাকায় এক বেসরকারী চাকরিজীবি তরুণীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ওই এলাকার ১৪জন যুবক মিলে গত ৭ জুলাই পাহাড়ে তুলে ওই তরুণী ধর্ষণ করেছে। চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে একটি প্রভাবশালী মহল। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১২ জুলাই সন্ধ্যায় মাতারবাড়ী থেকে ধর্ষিতা তরুনীকে পুলিশ উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাতারবাড়ীর ইউপি সদস্য শামিমা আক্তারকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে বলে জানা গেছে।
ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার ওই তরুণীর বাবার বাড়ি চকরিয়ার ডুলাহাজারায়। নানার বাড়ি মারতাবাড়িতে। পিতার সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন মাতারবাড়িতে। একসময় মায়ের দ্বিতীয় সংসারে আশ্রিত থাকলেও কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সে। সম্প্রতি মুঠোফোনে মহেশখালী পৌরসভার গোরকঘাটার এক ছেলে সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওই তরুণীর। ওই ছেলে সাথে দেখা করতে চট্টগ্রাম থেকে মহেশখালী এসেই এই নিষ্ঠুর ঘটনার শিকার হয় ওই তরুণী।
ধর্ষিতা মেয়েটির বরাত দিয়ে মাতার বাড়ী সিএনজি লাইনম্যান রশিদ জানান, ধর্ষণের শিকার মেয়েটি গত ৭ জুলাই সকাল ১০টার দিকে চালিয়াতলী স্টেশনের এসে নামে। তার উদ্দেশ্য ছিলো প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গোরকঘাটায় যাওয়া। তার আগে সে মাতাবাড়ী যায়। সেই মোতাবেক নলবিলা দরগাহপাড়া এলাকার শাহ আলমের পুত্র ওসমান গণির চালিত সিএনজিটি রিজার্ভ নেয় তরুণীটি। প্রথমে মাতারবাড়ি গিয়ে ফের একই সিএনজি করেই গোরকঘাটায় যায় ওই তরুণী। কিন্তু তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে ওই প্রেমিক ছেলেটি। গোরকঘাটা সিএনজি স্টেশনে প্রায় দেড়ঘন্টা অপেক্ষা করলেও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি ওই প্রতারক প্রেমিক। কথা ছিলো- সব গাড়ি ভাড়া ওই প্রেমিকই দেয়ার। কিন্তু প্রেমিক না আসায় অর্থ সংকটে সমস্যা পড়ে যায় তরুণীটি।
তার ভাষ্য মতে, প্রেমিক না আসায় একই সিএনজিতে করে আবার চালিয়াতলী ফিরে যায় ওই তরুণী। সেখানে ভাড়া দিতে না পারায় চালকের সাথে তার বেশ বাকবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দিয়ে ভাড়া মেটায় সে। তবে বাকবিতন্ডার কারণে জড়ো হয়ে যায় অনেক। ওই জড়ো হওয়াদের মধ্যে ছিলো স্থানীয় চালিয়াতলী এলাকার মৃত আবুল হাছির ছেলে আমির সালাম, মোস্তাক আহমদের ছেলে এনিয়া এবং নলবিলা দরগাহপাড়ার মোক্তার আহমদের ছেলে আদালত খাঁ।
মেয়েটির দাবি, ভাড়া নিয়ে তার সাথে বাক-বিতন্ডার এক পর্যায়ে সেখানে জড়ো হন আমির সালাম, এনিয়া ও সিএনজি চালক আদালত খাঁ (পরে চিহ্নিত)। ভাড়ার সমস্যা মিটে গেলে অন্যান্য লোকজন চলে যায়। কিন্তু সহযোগিতার প্রলোভন দিয়ে ওই তিনজন মিলে মেয়েটিকে চালিয়াতলী বালুরডেইল পাহাড়ি ঝিরি দিয়ে নিয়ে যায়। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরে তাদের সাথে সিএনজি চালক ওসমানসহ আরো ১১জন যোগ দেয়।
পরদিন ৮ জুলাই ভোরের শেষ মুহূর্তে মাতারবাড়ি-চালিয়াতলী সড়কের দরগাহঘোনা স্থানে মেয়েটিকে দেখতে পান স্থানীয় সুজন নামে এক মৎস্য ঘের ব্যবসায়ী। তখন মেয়েটির ছিলো অনেকটা ভীত-সন্ত্রস্ত এবং পোশাক ছিলো অস্বাভাবিক। এই অবস্থায় মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে তার কারণ জানতে চান মৎস্য ঘের ব্যবসায়ী সুজন। মেয়েটি তাকে জানান, পাহাড়ে আটকে রেখে ১৪জন মিলে তাকে রাতভর ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের পর তার বোরকা, হাতব্যাগ, ঘড়ি কেড়ে নেয় ধর্ষকেরা। মেয়েটিকে কিছু টাকা দিয়ে মাতারবাড়ি গাড়িতে তুলেন সুজন।
ওই দিনই এই ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। এই নিয়ে সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি জানাজানি হলে তা ধামাচাপা দেয়ার দৌড়ঝাঁপ শুরু ধর্ষকেরা। ধামাচাপা দেয়ার জন্য তারা একটি প্রভাবশালী মহলের আশ্রয় নেন। ওই মহলের প্রধান হোতা হলেন- মাতার বাড়ী সিএনজি লাইনম্যান রশিদ। ঘটনা ধামাচাপা দিতে ধর্ষকদের পক্ষ হয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে তিনি। তিনি স্থানীয় মেম্বার লিয়াকত আলী ও মাতারবাড়ি মহিলা মেম্বার শামীমার শরণাপন্ন হন। এই দুই মেম্বারকে নিয়ে সমঝোতার ‘মিশন’ শুরু হয়।
এদিকে, সাধারণ মানুষের চাপের মুখে ভয়ে রয়েছে ধামাচাপার চেষ্টাকারীরা। তারা ঘটনাটি পুরোদমে চুপিয়ে ফেলতে নানাভাবে চেষ্টা-তদবির অব্যাহত রেখেছে। এর অংশ হিসেবে ধর্ষিতাকে মাতারবাড়ির মহিলা মেম্বার শামীমার বাড়িতে ‘হেফাজত’র নামে আটকে রাখা হয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাই চাপে ও ভয়ে আইনী আশ্রয় নিতে পারছে না ধর্ষিতার পরিবার।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন মাতারবাড়ী সিএনজি লাইনম্যান রশিদ। তিনি এর সাথে জড়িত নেই দাবি করে বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর মেয়েটি মাতারবাড়ির মহিলা মেম্বার শামীমার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শামীমাকে মা ডেকে বিষয়টি তাকে জানান। পরে মেম্বার শামীমা মেয়েটিকে নিয়ে চালিয়াতলীর মেম্বার লিয়াকত আলীর কাছে যান। তখন লিয়াকত আলী টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি মীমাংসের প্রস্তাব দিলে তা মেনে নেন মেম্বার শামীমা। তবে টাকার অংক নিয়ে তাদের মধ্যে বনিবনা হয়নি।’
জানতে চাইলে চালিয়াতলী এলাকার মেম্বার লিয়াকত আলী বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনাটি সত্য। এটি একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। কিছু সিএনজি চালকসহ কয়েকজন নষ্ট ছেলে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এই ঘটনার মুলহোতা মাতারবাড়ী সিএনজি লাইনম্যান রশিদ।’ নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি আরো বলেন, ‘ঘটনাটি আমি জেনেছি গত পরশু (১০ জুলাই)। ওই দিন মাতারবাড়ির মহিলা মেম্বার শামীমা ঘটনাটি আমাকে জানান। তখন আমি তাকে থানায় মামলা করার পরামর্শ দিয়েছি।’
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মাতারবাড়ির মহিলা মেম্বার শামীমার সাথে যোগযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ ধর্ষিত তরুনীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার সময় পুলিশ মেম্বার শামিমা আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আসা হয়েছে বলে মাতারবাড়ী পুলিশ ফাড়িঁর এসআই আনিসুল হক জাননা।
ধর্ষিত তরুণী প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গোরকঘাটা আসার কথাটি সাংবাদিকদের অস্বীকার করে । তবে গাড়ী ভাড়া না থাকার বিষয় নিয়ে সিএনজি ড্রাইভারসহ ১২/১৪ মিল তাকে পাহাড়ের দিকে নিয়ে গিয়ে গণ ধর্ষণ করেছে বলে দাবী করেন।
মাতারবাড়ীর ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, মেয়েটি আমার এলাকার না হলেও ধর্ষণের ঘটনাটি খুবই মর্মাহত। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবী জানান। যদি আমার পরিষদের কোন সদস্য জড়িত থাকে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। মাতারবাড়ী থেকে ভিকটিম উদ্ধার এবং ইউপি সদস্য শামিমাকে পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে বলে সত্যতা নিশ্চত করেছে চেয়ারম্যান ।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জামিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাটি আমি ১২ জুলাই শুক্রবার বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি। এটা অত্যন্ত বর্বরোচিত ঘটনা। এটা কখনো মীমাংস হতে পারে না। বিষয়টি আমি দেখছি।’
মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রভাষ চন্দ্র ধর জানান, এমন একটি ঘটনা নিরবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মেয়েটিকে উদ্ধার থানায় নিয়ে আসা হচ্ছে বলে জানান। মেয়েটির সাথে কথা বলে আসল রহস্য উৎঘাটন হবে। পাশাপাশি অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান করা হচ্ছে।
Posted ১:২৮ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১৩ জুলাই ২০১৯
ajkerdeshbidesh.com | ajker deshbidesh